দ্বাদশ শ্রেণি
বিষয়- রাষ্ট্রবিজ্ঞান
সরকারের বিভিন্ন বিভাগ
প্রশ্ন- দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তি দাও।
উত্তর- গঠনগত দিক থেকে আইনসভাকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা- 1) এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভা এবং 2) দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা। নামগুলি শুনেই বোঝা যাচ্ছে যে, এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় একটিমাত্র কক্ষ থাকে; অপরপক্ষে, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার দুটি কক্ষ থাকে। আইনসভা এককক্ষবিশিষ্ট হলে সেখানে জনগণের দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই থাকেন। আর, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় সাধারণত নিম্নকক্ষটি জনগণের দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত হয় এবং উচ্চকক্ষের সদস্যগণ জনগণের দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত হন না। যেমন, ভারতের ক্ষেত্রে লোকসভা হল নিম্নকক্ষ এবং রাজ্যসভা হল উচ্চকক্ষ। লোকসভার প্রতিনিধিগণ জনগনের দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত হন কিন্তু রাজ্যসভার সদস্যগণ জনগণের দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত হন না।
এককক্ষবিশিষ্ট বনাম দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা
আইনসভা এককক্ষবিশিষ্ট হবে নাকি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট হবে, এই নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতপার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। বেন্থাম, ল্যাস্কি, আবে সিয়ে প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভার সমর্থক। অপরপক্ষে লর্ড ব্রাইস, জন স্টুয়ার্ট মিল, হেনরি মেইন, লর্ড অ্যাক্টন, গেটেল প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার সমর্থক। যাইহোক, নীচে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার পক্ষে এবং বিপক্ষে যুক্তিগুলি তুলে ধরা হল।
দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার পক্ষে যুক্তি
1) স্বৈরাচারী হওয়ার আশঙ্কা থাকে না- দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার উচ্চকক্ষটি সবসময় নিম্নকক্ষকে নিয়ন্ত্রণে রাখে। নিম্নকক্ষের কাজের সমালোচনা করে এবং তাদের কাজের ভুল ধরে উচ্চকক্ষ নিম্নকক্ষকে সংযত রাখে। এরফলে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা কখনোই স্বৈরাচারী হওয়ার সুযোগ পায় না।
2) যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে উপযোগী- যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থার সাফল্যের জন্য সরকারকে জাতীয় স্বার্থের পাশাপাশি আঞ্চলিক স্বার্থের দিকেও খেয়াল রাখতে হয়। একমাত্র দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার পক্ষেই জাতীয় স্বার্থ এবং আঞ্চলিক স্বার্থের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করা সম্ভব। এইজন্য বেশিরভাগ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মনে করেন যে, যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার পক্ষে অপরিহার্য হল দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা।
3) সুচিন্তিত আইন প্রণয়ন- এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভা অনেক সময়ই প্রবল ভাবাবেগের দ্বারা চালিত হয়ে অথবা জনমতের চাপে পড়ে আইন প্রণয়ন করে থাকে। আইনসভার দুটি কক্ষ থাকলে আইন প্রণয়নের পূর্বে দীর্ঘ আলাপ আলোচনার সুযোগ থাকে। সেইজন্য দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় সুচিন্তিত আইন প্রণীত হয়।
4) যথার্থ জনমতের প্রতিফলন ঘটে- পরোক্ষ গণতন্ত্রে যত বেশি সংখ্যক জনপ্রতিনিধি অংশগ্রহণ করবেন গণতন্ত্রের ভিত ততই মজবুত হবে। এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় জনপ্রতিনিধির সংখ্যা সীমিত হয়, কিন্তু দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় জনপ্রতিনিধির সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি হয়। এইভাবে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় অধিক জনমতের প্রতিফলন ঘটে। তাছাড়া দুটি কক্ষের নির্বাচন ভিন্ন ভিন্ন সময় হয় বলে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় পরিবর্তিত জনমতের প্রতিফলন ঘটতে দেখা যায়।
5) সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষিত হয়- এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ থাকে না। কিন্তু দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার উচ্চকক্ষে সংখ্যালঘুদের জন্য আসন সংরক্ষণ করে আইনসভায় তাদের প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা করা যায়।
6) বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের প্রতিনিধিত্ব- এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভার সদস্যগণ জনগণের দ্বারা প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন। নির্বাচনে অংশ নিতে হলে কোনো রাজনৈতিক দলের শরণাপন্ন হতে হবে অথবা নির্দল প্রার্থী হিসেবে ভোটে দাঁড়াতে হবে। কিন্তু বর্তমানে দলীয় রাজনীতি এতটাই কলুষতাপূর্ণ যে কোনো জ্ঞানীগুণী ব্যক্তি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চাইবেন না। যার ফলে এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিদের স্থান হয় না। কিন্তু দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার উচ্চকক্ষে এইসকল বিশিষ্ট ব্যক্তিদের অনায়াসে স্থান দেওয়া যায়।
দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার বিপক্ষে যুক্তি
1) অগণতান্ত্রিক আইনসভা- দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার দ্বিতীয় কক্ষটি পুরোপুরি বা আংশিকভাবে মনোনীত প্রার্থীদের নিয়ে গঠিত হয়। অর্থাৎ, তারা জনগণের দ্বারা প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইনসভার সদস্য হন না। এই কারণে অনেকে দ্বিতীয় কক্ষটিকে অগণতন্ত্রিক বলে থাকেন।
2) দায়িত্ব ও কর্তব্য বিষয়ে স্বচ্ছতার অভাব- এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় একটিমাত্র কক্ষ থাকে বলে অন্য কাউকে দোষারোপ করার ব্যাপার থাকে না। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় এক কক্ষ অপর কক্ষের উপর দোষারোপ করে নিজেদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাওয়ার চেষ্টা করে। বিশেষতঃ দুটি কক্ষে যদি দুটি ভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রাধান্য থাকে তাহলে এরূপ অবস্থার সৃষ্টি হয়।
3) দ্রুত সিদ্ধান্তগ্রহণ সম্ভব নয়- দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় কোনো আইন পাশ করতে গেলে সেই বিলটিকে দুটি কক্ষেই পাশ হতে হয়। পদ্ধতিগত জটিলতার কারণে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় আইন প্রণয়ন করতে বিলম্ব হয়। এইজন্য আপদকালীন কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা অপারগ।
4) ব্যয়ভার বেশি- আইনসভার দুটি কক্ষ থাকলে সদস্যসংখ্যা স্বাভাবিকভাবেই বেশি হবে এবং সদস্যদের বেতন, ভাতা ইত্যাদি বাবদ সরকারের বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হবে। তাই এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভার তুলনায় দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার ব্যয়ভারও অনেক বেশি।
5) স্ববিরোধিতার আশঙ্কা থাকে- দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার দুটি কক্ষের সদস্যদেরই প্রধান কাজ হল আইন প্রণয়ন করা। কিন্তু দুটি কক্ষে যদি দুটি ভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রাধান্য থাকে এবং দুই কক্ষের সদস্যগণ যদি পরস্পরের বিরোধিতায় লিপ্ত হন তবে আইন প্রণয়নের কাজে অচলাবস্থা দেখা দেবে।
পরিশেষে, ফরাসি পন্ডিত আবে সিয়েকে অনুসরণ করে বলা যায় যে, দ্বিতীয় কক্ষটি যদি প্রথম কক্ষের সঙ্গে একমত হয় তবে তা অনাবশ্যক, আর যদি একমত না হয় তবে তা ক্ষতিকর। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার দুটি কক্ষ যদি একই সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে দ্বিতীয় কক্ষের সত্যিই কোনো প্রয়োজন নেই। আবার, দুটি কক্ষ যদি সর্বদা একে অপরের বিরোধিতা করে থাকে তাহলেও আইনবিভাগ পঙ্গু হয়ে পড়বে।