রাষ্ট্রবিজ্ঞান (দ্বাদশ শ্রেণি)
অধ্যায়- সরকারের বিভিন্ন বিভাগ
[West Bengal Council of Higher Secondary Examination (WBCHSE) Higher Secondary Political Science Questions and Answers in Bengali; Chapter- Organs of Government; Question- Why implementation of separation of powers is not possible?]
প্রশ্ন- ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরন নীতি বলতে কী বোঝো? "কঠোর ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরন নীতি সম্ভব নয়, কাম্যও নয়"- মন্তব্যটির যথার্থতা বিচার করো। [2+6]
উত্তর- ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ (Separation of power) কথাটির অর্থ হল ক্ষমতার পৃথকীকরণ। সরকারের তিনটি বিভাগ যথাক্রমে আইনবিভাগ, শাসনবিভাগ এবং বিচারবিভাগ যখন স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ক্ষমতা প্রয়োগ করে, তখন তাকে বলা হয় ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতিটির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।
ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতি অনুযায়ী (1) সরকারের প্রতিটি বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করবে (অর্থাৎ, একটি বিভাগ অন্য বিভাগের কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না); (2) সরকারের প্রতিটি বিভাগ হবে স্বনিয়ন্ত্রিত (অর্থাৎ, একটি বিভাগ অপর বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করবে না) এবং (3) একজন ব্যক্তি একটি বিভাগের কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকবেন (অর্থাৎ, একজন ব্যক্তি একের বেশি বিভাগের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারবেন না)। প্রাচীনকাল থেকে অনেক রাষ্ট্র দার্শনিক ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির কথা বললেও ফরাসি দার্শনিক মন্তেস্কুকে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রবক্তা বলে গণ্য করা হয়।
ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়োগ
1748 খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত 'স্পিরিট অফ দি লজ' গ্রন্থে মন্তেস্কু বলেছেন যে, একই ব্যক্তি বা সংস্থার হাতে আইন রচনা ও শাসন ক্ষমতা থাকলে সেই ব্যক্তি বা সংস্থা স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠতে পারে। তার মতে, বিচারবিভাগকে আইনবিভাগ ও শাসনবিভাগের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করতে না পারলে নাগরিকদের ব্যক্তিস্বাধীনতা ক্ষুন্ন হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতি সম্পূর্ণরূপে প্রযুক্ত হয়েছে। এছাড়াও বিশ্বের অধিকাংশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি অল্পবিস্তর গৃহীত হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হল, কঠোর ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতি প্রয়োগ করা কি আদৌ সম্ভব? এই নীতি কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হলে সেটা কি রাষ্ট্র ও জনগণের পক্ষে হিতকর হবে? বেশিরভাগ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতে, "কঠোর ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরন নীতি সম্ভব নয়, কাম্যও নয়"। তাদের এই বক্তব্যের পিছনে যুক্তিগুলি হল-
1) ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির বাস্তব প্রয়োগ সম্ভব নয়। কারণ, এই নীতি অনুযায়ী সরকারের তিনটি বিভাগ স্বতন্ত্রভাবে কাজ করবে এবং একে অপরকে নিয়ন্ত্রণ করবে না। কিন্তু বাস্তবে সেটা সম্ভব নয়। যেকোনো ধরনের শাসনব্যবস্থাই হোক না কেন, এক বিভাগের সঙ্গে আরেক বিভাগের সম্পর্ক না থাকলে শাসনব্যবস্থা অচল হয়ে পড়বে। সরকারের তিনটি বিভাগ আলাদাভাবে কাজ করলেও সেই তিনটি বিভাগের মধ্যে যোগসুত্র স্থাপনের জন্য কোনো ব্যক্তি বা বিভাগের প্রয়োজন। কিন্তু ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতি অনুযায়ী একই ব্যক্তি একাধিক বিভাগের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারবে না। তাই এই নীতির বাস্তব প্রয়োগ সম্ভব নয়।
2) ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতি যদি বাস্তবে প্রয়োগ করা হয়, তবে হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কাই বেশি থাকবে। এই নীতি প্রয়োগ করলে সরকারের তিনটি বিভাগের মধ্যে সহযোগিতার পরিবর্তে প্রতিযোগিতা শুরু হবে এবং বিভাগ তিনটি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়বে বলে অনেকে মনে করেন।
3) তত্ত্বগতভাবে হলেও শাসনবিভাগ এবং আইনবিভাগের মধ্যে ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়োগ চলতে পারে, কিন্তু বিচারবিভাগকে অন্য দুই বিভাগের উপর নির্ভর হতেই হয়। কারণ, যে আইন অনুসারে বিচার হয় সেই আইন তৈরি করে আইনবিভাগ এবং বিচারপতিদের নিয়োগ করে শাসনবিভাগ। আবার, বিচারপতিদের জনগণের মাধ্যমে নির্বাচিত করা হলে তারা আবার দলীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়তে পারে। সেক্ষেত্রে বিচারকার্য কতটা ন্যায়সঙ্গত হবে বলাই বাহুল্য।
4) সরকারের তিনটি বিভাগের মধ্যে আইনবিভাগ সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী। আর, যদি আইনবিভাগ স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে সেক্ষেত্রে শাসনবিভাগ এবং বিচারবিভাগের কিছু করার থাকে না। সুতরাং ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতি প্রয়োগ করার চেয়ে বেশি জরুরি আইনবিভাগকে স্বৈরাচারীতা রোধ করা। তাহলেই ব্যক্তিস্বাধীনতা সুরক্ষিত থাকবে।
5) সর্বোপরি, সরকারের প্রতিটি বিভাগ পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করে। জীবদেহের প্রতিটি অঙ্গ-প্ৰত্যঙ্গ যেমন একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, সরকারের তিন বিভাগের মধ্যেও তেমনি সম্পর্ক থাকা প্রয়োজন। সরকারের তিনটি বিভাগকে বিচ্ছিন্ন করে দিলে সরকারের সামগ্রিক কার্যকারিতা হ্রাস পাবে বলে অনেকে মত পোষণ করেছেন।
পরিশেষে বলা যায়, সরকারের যাবতীয় ক্ষমতা একটিমাত্র বিভাগের হাতে কেন্দ্রীভূত হলে ক্ষমতার অপব্যবহার হতে বাধ্য। সরকারের স্বৈরাচারীতা রোধ করার জন্য ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়োজন রয়েছে। তবে এটাও ঠিক যে, এই নীতির সার্বিক প্রয়োগ সম্ভব নয় এবং কাম্যও নয়।