রাষ্ট্রবিজ্ঞান (দ্বাদশ শ্রেণি)
অধ্যায়- ভারতের বিচারব্যবস্থা
[West Bengal Council of Higher Secondary Examination (WBCHSE) Class 12 Political Science Questions and Answers in Bengali; Chapter- Indian Judiciary; Question- Structure and Functions of Lok Adalats.]
প্রশ্ন- ভারতের লোক আদালতের গঠন ও কার্যাবলি সংক্ষেপে বিশ্লেষণ করো। [4+4]
উত্তর- ভারতের বিচারব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো বিশেষ আদালতের অবস্থিতি। এইসব আদালতগুলি মূল বিচারব্যবস্থার ওপর চাপ কমাতে সাহায্য করে এবং অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলির দ্রুত নিষ্পত্তি করে জনগণের জন্য ন্যায়বিচারকে সুরক্ষিত করে। ভারতে যে সকল বিশেষ আদালত রয়েছে, তাদের মধ্যে লোক আদালত অন্যতম।
লোক আদালত
ভারতের মতো একটি বিপুল জনসংখ্যাবিশিষ্ট রাষ্ট্রের পক্ষে সকলের জন্য ন্যায় সুনিশ্চিত করা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এখানে বিরোধের তুলনায় আদালতের সংখ্যা নগণ্য। প্রতিটি আদালতে কাজের চাপ অত্যন্ত বেশি এবং সেইজন্য একজন বিচারপ্রার্থীর ন্যায়বিচার পেতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। আবার সকলের পক্ষে আদালতের দ্বারস্থ হওয়া সম্ভব হয় না। কারণ, প্রথাগত আদালতে আইনজীবী এবং অন্যান্য কোর্ট-ফি বাবদ অনেক টাকা খরচ করতে হয়, যা সাধারণ গরিব মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। এইসব সমস্যার সমাধানের জন্য ভারতে লোক আদালত গঠন করা হয়েছে। লোক আদালত হল এমন এক ধরনের বিচারালয় যেখানে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলির সম্পূর্ণ বিনা খরচে এবং দ্রুত নিষ্পত্তি হয়।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত
ভারতের প্রথম লোক আদালত গড়ে উঠেছিল গুজরাটে, 1982 সালের মার্চ মাসে। এরপর একে একে দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ, তামিলনাড়ু প্রভৃতি রাজ্যেও লোক আদালত গড়ে ওঠে। 1987 সালে আইনি পরিষেবা কর্তৃপক্ষ আইন (Legal Services Authorities Act, 1987) কার্যকর হওয়ার ফলে লোক আদালত আইনগত ভিত্তি লাভ করেছে। বর্তমানে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে লোক আদালত গড়ে উঠেছে।
লোক আদালতের গঠন
আইনি পরিষেবা কর্তৃপক্ষ আইনের (1987) সংশোধন হয় 1994 সালে। এই সংশোধনী আইনের-
19 (1) নং ধারায় কেন্দ্র, রাজ্য, জেলা ও তালুকে আইনি পরিষেবা কর্তৃপক্ষ গঠন করার কথা বলা হয়েছে। এই কর্তৃপক্ষের হাতে লোক আদালত গঠন করার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে।
19 (2) নং ধারা অনুযায়ী একটি অঞ্চলের লোক আদালত (i) কর্মরত কিংবা অবসরপ্রাপ্ত বিচারবিভাগীয় আধিকারিক এবং (ii) অন্য কয়েকজন ব্যক্তিকে নিয়ে গঠিত হবে। অন্য কয়েকজন ব্যক্তি বলতে সাধারণত আইনজীবী, সমাজসেবী প্রভৃতি বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে লোক আদালতের সদস্য হিসাবে নিয়োগ করা হয়। বিচারবিভাগীয় আধিকারিক আদালতের চেয়ারম্যান হিসেবে কার্য সম্পাদন করেন।
বর্তমানে বিভিন্ন রাজ্যে যেমন লোক আদালত গঠন করা হয়েছে, তেমনি সরকারি পর্যায়ে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য বিভিন্ন লোক আদালত গঠিত হয়েছে। সবক্ষেত্রেই মোটামুটি গঠনপদ্ধতি একইরকম।
লোক আদালতের কার্যাবলি
লোক আদালত এক ধরণের বিশেষ আদালত। সাধারণ আদালতের মতো লোক আদালতেও বিচার করা হয় এবং বিরোধের মীমাংসা করা হয়। বিচারব্যবস্থায় লোক আদালতগুলির ভূমিকা এইরকম-
লোক আদালতে সাধারণত অপেক্ষাকৃত কম জটিল এবং কম গুরুত্বপূর্ণ বিরোধের মীমাংসা হয়ে থাকে। এই আদালতের বিচার্য বিষয়ের মধ্যে রয়েছে দাম্পত্য বিরোধ, পারিবারিক সম্পত্তি সংক্রান্ত বিবাদ, দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতিপূরণ, বীমা সংক্রান্ত দাবি ইত্যাদি। তবে, লোক আদালতের কার্যাবলী দেওয়ানী মামলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে।
সাধারণ আদালতে দীর্ঘদিন ধরে অমীমাংসিত অথবা বিচার শুরু হবার আগেই কোনো আদালত বা আইনি কর্তৃপক্ষ বিরোধটিকে লোক আদালতে পাঠাতে পারে। কিন্তু বিবদমান দুই পক্ষই যদি মেনে নেয়, তবেই সেই বিবাদটিকে লোক আদালতে বিচারের জন্য পাঠানো হয়।
বিবদমান দুই পক্ষের মধ্যে এক পক্ষকে লোক আদালতে বিচারের প্রার্থনা করে লিখিতভাবে আবেদন জানাতে হয়। আবেদন গৃহীত হলে লোক আদালতের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। সাধারণ আদালতের মতো লোক আদালতেও সাক্ষী-প্রমাণের ভিত্তিতে বিচার করা হয়। উভয় পক্ষই আদালতের রায় মানতে বাধ্য থাকে। লোক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে অন্য আদালতে আপিল করা যায় না। তবে, এই আদালত যদি কোনো বিরোধের মীমাংসা করতে ব্যর্থ হয়, তখন অন্য আদালতে বিচারের জন্য আবেদন করা যায়।
পরিশেষে বলা যায়, ভারতের বিচারব্যবস্থায় লোক আদালতগুলি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এখন সাধারণ আদালতের কাজের চাপ কিছুটা হলেও কম হয়েছে। সম্পূর্ণ বিনা খরচে, দ্রুত বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে লোক আদালতগুলি জনগণের জন্য ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত করে গণতন্ত্রের ভিতকে মজবুত করছে।