Role and Powers of the Prime Ministers of India || ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও কার্যাবলি
দ্বাদশ শ্রেণি
বিষয়- রাষ্ট্রবিজ্ঞান
ভারতের শাসন বিভাগ
প্রশ্ন- ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও কার্যাবলী আলোচনা করো। [8]
উত্তর- সংবিধান অনুসারে ভারতের সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছে। সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় একজন নামসর্বস্ব শাসক থাকেন যিনি সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্রের প্রধান এবং প্রকৃত শাসন ক্ষমতা ভোগ করেন প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রীপরিষদ। ভারতের রাষ্ট্রপতি হলেন নামসর্বস্ব শাসক এবং প্রধানমন্ত্রীই হলেন ভারতের শাসন বিভাগের সর্বময় কর্তা।
ভারতের প্রকৃত শাসক প্রধানমন্ত্রী হলেও ভারতের সংবিধানে কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা এবং পদমর্যাদা সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়নি। সংবিধানের 74 নম্বর ধারা অনুসারে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি মন্ত্রিপরিষদ থাকার উল্লেখ রয়েছে। সংবিধানের 75 নম্বর ধারা অনুসারে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীকে নিয়োগ করে থাকেন। সাধারণত লোকসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বা নেত্রীকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করা হয়। তবে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে গেলে লোকসভার সদস্য হতেই হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা
ভারতের প্রধানমন্ত্রী হলেন ভারতের শাসন বিভাগের প্রধান কর্ণধার। ভারতীয় শাসনতন্ত্রে প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা হলো এই রকম-
1) রাষ্ট্রপতির প্রধান পরামর্শদাতা হিসেবে- সংবিধান অনুসারে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর মূল কাজই হল ভারতের রাষ্ট্রপতিকে শাসনকার্যে সহায়তা করা। কিন্তু প্রকৃত বিচারে, ভারতের রাষ্ট্রপতি যে সকল ক্ষমতা ভোগ করেন সেইসব ক্ষমতা প্রয়োগ করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী, সেখানে রাষ্ট্রপতির ভূমিকা নিছক 'জাঁকজমকপূর্ণ সাক্ষীগোপালের' মতো। সহজভাবে বললে, প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে ভারতের রাষ্ট্রপতি শাসনকার্য পরিচালনা করেন। একইসঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতি এবং মন্ত্রিপরিষদের মধ্যে সংযোগরক্ষাকারীর ভূমিকা পালন করেন।
2) লোকসভার নেতা বা নেত্রী হিসেবে- লোকসভার নেতা বা নেত্রী হিসেবে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। লোকসভার অধিবেশন কখন শুরু হবে, কতদিন চলবে এবং কোন কোন বিষয়ে আলোচনা হবে ইত্যাদি বিষয়ে তিনিই সিদ্ধান্ত নেন। আবার সরকারের প্রধান মুখপাত্র হিসেবে প্রধানমন্ত্রী সরকারি নীতিসমূহের ব্যাখ্যা করেন।
3) মন্ত্রীপরিষদ গঠন সংক্রান্ত- মন্ত্রী পরিষদ গঠনের ব্যাপারে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তার পরামর্শেই ভারতের রাষ্ট্রপতি মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্যদের নিয়োগ করে থাকেন।
4) ক্যাবিনেটের নেতা হিসেবে- ক্যাবিনেট হল মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীদের নিয়ে ছোট আকারের মন্ত্রীসভা। সংসদীয় গণতন্ত্রে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ক্যাবিনেটেই গৃহীত হয়। প্রধানমন্ত্রী হলেন এই ক্যাবিনেটের প্রধান স্তম্ভ। তার পরামর্শে রাষ্ট্রপতি ক্যাবিনেট মন্ত্রীদের নিয়োগ ও পদচ্যুত করেন। কাকে কোন দপ্তর দেওয়া হবে তাও ঠিক করে দেন প্রধানমন্ত্রী। পদাধিকার বলে তিনি ক্যাবিনেটের সভাপতি। শুধু তাই নয়, ক্যাবিনেটের যে সকল কমিটি থাকে, সেইসব কমিটিরও সভাপতি তিনি। ক্যাবিনেটের নেতা হিসাবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী সমগ্র শাসনবিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করেন।
5) দল এবং জোটের নেতা হিসেবে- প্রধানমন্ত্রী যে রাজনৈতিক দলের নেতা বা নেত্রী হন, সেই দলের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল রাখতে এবং দলীয় সংগঠন মজবুত করে দলীয় নীতিসমূহ বাস্তবায়িত করতে উদ্যোগী হন। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিত্ব, বিচক্ষণতা, দূরদর্শীতা এবং সাংগঠনিক ক্ষমতা তার দলকে জনপ্রিয়তার শিখরে নিয়ে যেতে পারে। তাছাড়া লোকসভা নির্বাচনে যদি কোনো দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পায় সেক্ষেত্রে জোট গঠন করা হয় এবং প্রধানমন্ত্রীকে সেই জোটের অন্যান্য শরিকদের সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রাখতে হয়।
6) পররাষ্ট্র বিষয়ক- ভারতের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকেন। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জহরলাল নেহেরুর আমল থেকেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী হলেন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ভারতের প্রধান মুখপাত্র। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তিনি ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি ভারত-সফররত অন্যান্য রাষ্ট্রপ্রধানদের স্বাগত জানান এবং শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।
7) নিয়োগ সংক্রান্ত- ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব কোনো নিয়োগ-সংক্রান্ত ক্ষমতা না থাকলেও ভারতের গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারীদের নিয়োগের ক্ষেত্রে তিনি রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দিয়ে থাকেন। প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে রাষ্ট্রপতি ভারতের অ্যাটর্নি জেনারেল, মহাহিসাব নিয়ামক ও নিরীক্ষক, নির্বাচন কমিশনার প্রভৃতি বিশিষ্ট পদাধিকারীদের নিয়োগ করেন।
8) জাতির নেতা হিসেবে- সমস্ত রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক পরিচয়ের ঊর্ধ্বে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হলেন 'জাতির নেতা'। তার এই পরিচয়টি বিশেষ তাৎপর্যবহ। বিভিন্ন সময়ে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। জাতীয় ক্ষেত্রে কোনো সংকটময় পরিস্থিতির উদ্ভব হলে তিনি দেশবাসীকে আশ্বস্ত করেন এবং সেই পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য তার সরকার কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, সেই বিষয় জনসমক্ষে তুলে ধরেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর পদমর্যাদা
ভারত সরকারের পদাধিকার-ক্রম অনুযায়ী ভারতের প্রধানমন্ত্রীর স্থান রাষ্ট্রপতি এবং উপরাষ্ট্রপতির পরে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনিই ভারতের শাসনবিভাগের প্রধান কর্তা। ভারতের শাসনব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে অনেকেই তাকে 'একনায়ক' বলে অভিহিত করে থাকেন।
আবার, অনেকেই তাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির থেকেও অধিক ক্ষমতাবান বলে মন্তব্য করেছেন। কারণ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি প্রযুক্ত থাকায় মার্কিন রাষ্ট্রপতি আইন বিভাগ এবং বিচার বিভাগের কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারেন না। কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী কেন্দ্রীয় আইন বিভাগ এবং শাসন বিভাগের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এবং ক্ষেত্রবিশেষে বিচার বিভাগকেও প্রভাবিত করতে পারেন।
পরিশেষে বলা যায়, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর পদমর্যাদা তার ব্যক্তিত্বের উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। আবার, লোকসভায় তার দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতার উপরেও তার ভূমিকা অনেকটা নির্ভর করে। লোকসভায় একক-সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হলে মন্ত্রিপরিষদ ও ক্যাবিনেটে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে কিন্তু জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রীকে শরিকদের মন জুগিয়ে চলতে হবে।