Header Ads Widget

header ads

Ticker

6/recent/ticker-posts

দ্বাদশ শ্রেণি- মার্কসের রাষ্ট্রচিন্তা

Marxian Theory of state

মার্ক্সের রাষ্ট্র্বতত্ত্ব


রাষ্ট্রবিজ্ঞান (দ্বাদশ শ্রেণি)
অধ্যায়- কয়েকটি প্রধান রাজনৈতিক মতাদর্শ


[West Bengal Council of Higher Secondary Examination (WBCHSE) Political Science Questions and Answers in Bengali; Chapter- Some Major Political Doctrines; Question- Marxian Theory of state.]


প্রশ্ন- মার্কসের রাষ্ট্র সম্পর্কিত তত্ত্বটি আলোচনা করো। [8]


উত্তর- রাষ্ট্রের উৎপত্তি এবং বিকাশ সম্পর্কে যে ক'টি মতবাদ প্রচলিত রয়েছে, তাদের মধ্যে মার্কসের তত্ত্বটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মার্কস এবং তার সহযোগী এঙ্গেলসের লেখা 'কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো', এঙ্গেলসের লেখা 'দি অরিজিন অফ দি ফ্যামিলি, প্রাইভেট প্রপার্টি এন্ড দি স্টেট' ইত্যাদি গ্রন্থে মার্কসের রাষ্ট্রদর্শন লিপিবদ্ধ রয়েছে। রাষ্ট্র সম্পর্কিত মার্কসীয় তত্ত্বটি এইরকম-


রাষ্ট্রের উদ্ভব- মার্কসবাদী রাষ্ট্রদর্শনে রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে কোনো উদ্ভট এবং অবিশ্বাস্য তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। মার্কসের মতে, রাষ্ট্র কোনো শাশ্বত প্রতিষ্ঠান নয়; আকস্মিকভাবেও রাষ্ট্রের উদ্ভব হয় নি।; সমাজ-বহির্ভুত কোনো শক্তির দ্বারা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাদের মতে, সমাজ বিবর্তনের একটি বিশেষ স্তরে যখন অর্থনৈতিক বিকাশের কারণে সমাজে শ্রেণীবৈষম্য তৈরী হল, তখন রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল। অর্থাৎ, অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তনের ফলে সমাজ শ্রেণিবিভক্ত হয়েছিল এবং এই শ্রেণিবিভক্ত সমাজই রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছিল।


রাষ্ট্রের বিবর্তন- মার্কস-এঙ্গেলস রাষ্ট্রের উৎপত্তি এবং বিবর্তনের একটি সুস্পষ্ট রূপরেখা তুলে ধরেছেন। তাদের মতে, অনাদিকাল থেকে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ছিল না। রাষ্ট্রের উদ্ভবের আগে যে সকল সমাজ ছিল সেগুলি ছিল সাম্যবাদী এবং সমভোগবাদী। তখন সকলেই নিজের সাধ্যমত শ্রমদান করত এবং নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী সুযোগ-সুবিধা ভোগ করত। এই আদিম সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থায় কোনো শ্রেণীর অস্তিত্ব ছিল না। যাইহোক, একসময় অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটে এবং তার অনিবার্য পরিণতি হিসেবে সমাজে শ্রেণিবিভাজন আসে এবং রাষ্ট্রের জন্ম হয়। তারপর বিভিন্ন সময় সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থায় পরিবর্তন এসেছে এবং সেই অনুযায়ী রাষ্ট্রের প্রকৃতিতেও পরিবর্তন সূচিত হয়েছে।


রাষ্ট্রের প্রকৃতি- রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে মার্কস দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, রাষ্ট্র হল শ্রেণি শোষণের যন্ত্র। বস্তুত, শ্রেণিবিভক্ত সমাজে রাষ্ট্র আধিপত্যকারী শ্রেণি কর্তৃক নির্যাতিত-নিপীড়িত শ্রেণিকে শাসন ও শোষণের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। যেমন-


1) দাস সমাজে রাষ্ট্র দাস মালিকের হাতে দাস শোষণের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে।

2) সামন্ততান্ত্রিক সমাজে রাষ্ট্র ছিল সামন্তপ্রভু কর্তৃক ভূমিদাসদের নির্যাতন, নিপীড়নের যন্ত্র।

3) পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে রাষ্ট্রযন্ত্র মালিক শ্রেণী কর্তৃক শ্রমিকশ্রেণীকে দমন-পীড়ন এবং শোষণের কাজে লিপ্ত থাকে।

4) সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার পতন ঘটবে এবং সর্বহারার একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে।


রাষ্ট্রের অবলুপ্তি- কার্ল মার্কস রাষ্ট্রবিজ্ঞানী নন, তিনি একজন রাষ্ট্রদার্শনিক। তাই তিনি রাষ্ট্রের উৎপত্তি এবং বিকাশের ধারা সম্পর্কে আলোচনা করেই ক্ষান্ত হন নি, রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও তার মতামত ব্যক্ত করেছেন। মার্কসের মতে, একসময় রাষ্ট্র লোপ পাবে। সমাজতান্ত্রিক সমাজ যখন সাম্যবাদী সমাজে পরিণত হবে তখন সমাজের শ্রেণিবিভাজন লোপ পাবে এবং শ্রেণিবৈষম্যহীন সমাজে শ্রেণী শোষণের যন্ত্র হিসেবে রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা আর থাকবে না।


সমালোচনা- রাষ্ট্র সম্পর্কিত মার্কসের তত্ত্বকে বিভিন্নভাবে সমালোচনা করা হয়। যেমন-


প্রথমত- মার্কসীয় রাষ্ট্রচিন্তায় রাষ্ট্রের উৎপত্তি এবং বিবর্তনের কারণ হিসেবে শুধুমাত্র অর্থনীতির ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। কিন্তু সমাজ বিবর্তনের ক্ষেত্রে ধর্ম, নৈতিকতা, আদর্শ ইত্যাদির বিশেষ ভূমিকা রয়েছে যা মার্কসীয় রাষ্ট্রতত্ত্বে পুরোপুরি উপেক্ষিত হয়েছে।


দ্বিতীয়ত- এই তত্ত্বে রাষ্ট্রকে 'শ্রেণী শোষণের যন্ত্র' হিসেবে উপস্থাপিত করা হয়েছে। কিন্তু এটি রাষ্ট্র সম্পর্কিত নেতিবাচক ধারণা। রাষ্ট্রের জনহিতকর রূপটি মার্কসবাদে উপেক্ষিত হয়েছে।


তৃতীয়ত- মার্কসবাদে পুঁজিবাদের অবসান ঘটিয়ে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে সর্বহারার একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সশস্ত্র বিপ্লবের নামে নির্বিচারে হত্যালীলা কখনোই সমর্থনযোগ্য নয়।


চতুর্থত- সমাজ বিকাশের চূড়ান্ত পর্যায়ে সর্বহারার একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে এবং শ্রেণিহীন সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠবে বলে মার্কস আশা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু সর্বহারার একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সর্বহারা শ্রেণি যে সুবিধাভোগী শ্রেণিতে পরিণত হবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়?


পরিশেষে বলা যায়, রাষ্ট্রের উৎপত্তি এবং বিকাশ সম্পর্কে মার্কসের তত্ত্বটি সমালোচনার শিকার হলেও অন্যান্য তত্ত্ব অপেক্ষা মার্কসীয় তত্ত্বটি অনেক বেশি বিজ্ঞানসম্মত এবং সেইজন্য অধিক গ্রহণযোগ্য। মার্কস এবং এঙ্গেলস রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে কোনোরূপ কল্পনাবিলাসিতা করেন নি, বরং সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিকভাবে রাষ্ট্রের উদ্ভব ও বিকাশের বিষয়টি আলোচনা করেছেন।