দ্বাদশ শ্রেণি
বিষয়- রাষ্ট্রবিজ্ঞান
সরকারের বিভিন্ন বিভাগ
প্রশ্ন- আধুনিক রাষ্ট্রের শাসনবিভাগের কার্যাবলী আলোচনা করো। [8]
উত্তর- আধুনিক রাষ্ট্রের প্রধান তিনটি অঙ্গ হল আইনবিভাগ, শাসনবিভাগ এবং বিচারবিভাগ। সহজভাবে বললে, আইনবিভাগের কাজ হল আইন প্রণয়ন করা; শাসনবিভাগের কাজ সেই আইন বলবৎ করে রাষ্ট্র পরিচালনা করা এবং কোনো নাগরিক বা প্রতিষ্ঠান যদি আইনবিরুদ্ধ কিছু কাজ করে থাকে, তার বিচার করে বিচারবিভাগ। তত্ত্বগতভাবে এই তিনটি বিভাগই সমান গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্রে শাসনবিভাগের গুরুত্বই সবথেকে বেশি। বর্তমান বিশ্বের প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রের শাসনবিভাগ আইনবিভাগ ও বিচারবিভাগের উপর প্রভাব বিস্তার করছে।
শাসনবিভাগের কার্যাবলি- অধ্যাপক অ্যালান বলের মতে, শাসনবিভাগের আসল কাজ হলো নীতি নির্ধারণ করা। আর এই নীতির রূপায়নের উপরই নির্ভর করে শাসনবিভাগের সাফল্য বা ব্যর্থতা। আধুনিক রাষ্ট্রে শাসনবিভাগ রাষ্ট্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সমস্ত বিষয়ে নীতি নির্ধারণ করে এবং সেই নীতিগুলি বাস্তবায়নের চেষ্টা করে। নীচে শাসনবিভাগের গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলি তুলে ধরা হল।
1) অভ্যন্তরীণ শাসন বিষয়ক কার্যাবলি- শাসনবিভাগের অন্যতম প্রধান কাজ হল দেশের অভ্যন্তরে আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখা। অভ্যন্তরীণ শান্তিরক্ষার উদ্দেশ্যে স্বরাষ্ট্র দপ্তরের অধীনে পুলিশ বাহিনী নিযুক্ত থাকে। তাছাড়া, আইনবিভাগ প্রণীত আইনগুলি কার্যকর করা শাসনবিভাগের দায়িত্ব। প্রশাসনিক কাজকর্ম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য বিভিন্ন দপ্তরে কর্মী নিয়োগ এবং তাদের পদোন্নতি, পদচ্যুতি ও বদলির বিষয়টি শাসনবিভাগের কর্মতালিকায় পড়ে। জরুরি অবস্থার মোকাবিলা করার জন্য শাসনবিভাগ অধ্যাদেশ জারি করে।
2) পররাষ্ট্র বিষয়ক কার্যাবলি- শাসনবিভাগের পররাষ্ট্র বিষয়ক কার্যাবলির মধ্যে রয়েছে পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ, অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলা, বিভিন্ন রকম চুক্তি সম্পাদন ইত্যাদি। সাধারণত রাষ্ট্রপ্রধানরাই এইসব কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। বর্তমানে প্রতিটি রাষ্ট্রের একটি স্বতন্ত্র পররাষ্ট্র দপ্তর রয়েছে এবং যত দিন যাচ্ছে এই দপ্তরের গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে।
3) প্রতিরক্ষা বিষয়ক কার্যাবলি- রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতা ও স্বাধীনতা রক্ষা এবং বহিঃশত্রুর আক্রমণের হাত থেকে রাষ্ট্রকে রক্ষা করার গুরুদায়িত্ব শাসন বিভাগের হাতে ন্যস্ত হয়েছে। শাসন বিভাগের প্রধান পদাধিকারবলে সামরিক বাহিনীর প্রধান হন এবং রাষ্ট্রকে সুরক্ষিত করার জন্য সামরিক বাহিনী গঠন, সেনানায়ক নিয়োগ, সমরাস্ত্র মজুত করার মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। প্রতিরক্ষা বিষয়ক কার্যাবলী তদারকির জন্য প্রতিটি রাষ্ট্রেরই একটি করে প্রতিরক্ষা দপ্তর রয়েছে।
4) আইন সংক্রান্ত কার্যাবলি- আইন প্রণয়নের কাজটি সাধারণত আইন বিভাগই করে থাকে কিন্তু ভারতের মতো সংসদীয় গণতন্ত্রে শাসন বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আবার আইন বিভাগেরও অংশ। যেমন, ভারতের প্রকৃত শাসক হলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং তিনি আবার আইনসভার সদস্য। এইভাবে আইন বিভাগের উপর শাসন বিভাগের প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে। তাছাড়া অনেক রাষ্ট্রে শাসন বিভাগীয় প্রধান আইনসভার অধিবেশন আহ্বান করতে, স্থগিত রাখতে এবং প্রয়োজন মনে করলে আইনসভা ভেঙে দেওয়ার নির্দেশ দিতে পারেন। আবার, বর্তমানে আইনবিভাগ কর্তৃক অর্পিত ক্ষমতাবলে শাসন বিভাগ কিছু কিছু আইন প্রণয়ন করে থাকে। সেইসব আইনকে বলা হয় অর্পিত ক্ষমতা প্রসূত আইন।
5) বিচার সংক্রান্ত কার্যাবলি- বেশিরভাগ রাষ্ট্রে শাসন বিভাগীয় প্রধান বিচারপতিদের নিয়োগ করে থাকেন এবং আদালতে দন্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে ক্ষমা প্রদর্শন করা, দন্ড হ্রাস করার মতো কিছু বিশেষ ক্ষমতাও ভোগ করে থাকেন।
6) অর্থ সংক্রান্ত কার্যাবলি- শাসনকার্য পরিচালনা করার জন্য কোন খাতে কত বরাদ্দ হবে, কীভাবে সেই অর্থের সংস্থান হবে ইত্যাদি বিষয়ে মূলত শাসন বিভাগই উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকে।
7) জনকল্যাণমূলক কার্যাবলি- আধুনিককালে অধিকাংশ রাষ্ট্রেই হল জনকল্যাণকর রাষ্ট্র। জনগণের সার্বিক উন্নতির স্বার্থে শাসনবিভাগ বিভিন্ন রকম জনসেবামূলক কর্মসূচি ও পরিকল্পনা গ্রহণ করে থাকে এবং সেগুলি রূপায়নে সচেষ্ট থাকে। শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি, কৃষি-শিল্প ও বাণিজ্যের উন্নতি, কর্মসংস্থান, কারিগরি শিক্ষা প্রদান ইত্যাদি নানাবিধ কাজ শাসনবিভাগের জনকল্যাণমূলক কাজের মধ্যে পড়ে।
8) অন্যান্য- শাসন বিভাগের অন্যান্য কার্যাবলির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল জরুরি অবস্থার মোকাবিলা সংক্রান্ত কার্যাবলি। কোনো কারণে দেশে সংকটজনক পরিস্থিতির উদ্ভব হলে শাসন বিভাগের প্রধান সেই অবস্থা মোকাবিলা করার জন্য কিছু ক্ষমতা ভোগ করে থাকেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ভারতের রাষ্ট্রপতির হাতে তিন ধরনের জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার ক্ষমতা রয়েছে।
পরিশেষে বলা যায়, আধুনিক রাষ্ট্রের কার্যাবলী উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিবর্তিত এই পরিস্থিতিতে শাসন বিভাগের ভূমিকাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। অবশ্য জনকল্যাণকর রাষ্ট্রের ধারণাকে বাস্তবায়িত করতে হলে শাসন বিভাগের অতিসক্রিয়তাই কাম্য।