Header Ads Widget

header ads

Ticker

6/recent/ticker-posts

দ্বাদশ শ্রেণি- ভারতের বিচারব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যসমুহ

দ্বাদশ শ্রেণি
বিষয়- রাষ্ট্রবিজ্ঞান

ভারতের বিচারবিভাগ

প্রশ্ন- ভারতের বিচারব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যসমুহ আলোচনা করা৷ [8]



উত্তর- আধুনিক রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থার প্রধান তিনটি স্তম্ভ হল আইনবিভাগ, শাসনবিভাগ এবং বিচারবিভাগ। আইনবিভাগ আইন রচনা করে, শাসনবিভাগ সেই আইন কার্যকর করে এবং আইন অমান্য করলে তার বিচার করে বিচারবিভাগ। যেকোনো রাষ্ট্রব্যবস্থায় বিচারবিভাগের বিশেষ ভূমিকা থাকে। অধ্যাপক গার্নার যথার্থই বলেছেন "বিচারবিভাগ ছাড়া সভ্য রাষ্ট্রের কল্পনা করা যায় না"। স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচারবিভাগের ওপর গণতন্ত্রের সাফল্য অনেকটা নির্ভর করে। ভারত বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র এবং এখানেও একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

ভারতের বিচারব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য

নীচে ভারতের বিচারব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি তুলে ধরা হল।

1) অখন্ড বিচারব্যবস্থা- ভারতের বিচারব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল এর অখন্ডতা। ভারতের শাসনব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রীয় হলেও অন্যান্য যুক্তরাষ্ট্রের মতো এখানে দ্বৈত বিচারব্যবস্থা নেই। সমগ্র ভারতে এক অখন্ড বিচারব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। এই বিচারব্যবস্থার শীর্ষে রয়েছে সুপ্রিম কোর্ট, দ্বিতীয় স্তরে রয়েছে হাইকোর্টগুলি এবং হাইকোর্টের অধীনে রয়েছে বিভিন্ন প্রকার দেওয়ানী ও ফৌজদারী আদালতসমূহ।

2) অভিন্ন আইন- ভারতের বিচারব্যবস্থা যেমন অখন্ড, তেমনি সমগ্র দেশে একই আইন অনুসারে বিচারকার্য সম্পাদিত হয়। দেশের যেকোনো প্রান্তে যেকোনো আদালতের বিচারপতিগণ অভিন্ন আইন অনুসরণ করে বিচার করে থাকেন।

3) নিরপেক্ষতা- তত্ত্বগতভাবে ভারতে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। বিচারপতিরা যাতে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে বিচারকার্য সম্পাদন করতে পারেন, সেইজন্য সংবিধানে কয়েকটি ব্যবস্থার উল্লেখ রয়েছে। যেমন, (i) প্রমাণিত অসদাচরণ ও অক্ষমতা ছাড়া অন্য কোনো কারণে কোনো বিচারপতিকে পদচ্যুত করা যায় না, (ii) পার্লামেন্টে বিচারপতিদের রায়ের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায় না, (iii) অবসর গ্রহণের পর কোনো বিচারপতি ভারতের কোনো আদালতে আইনজীবী হিসেবে কাজ করতে পারেন না ইত্যাদি।

4) আইনের সাংবিধানিকতা বিচার- ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত হিসেবে সুপ্রিম কোর্ট আইনসভা প্রণীত যেকোনো আইনকে সংবিধানবিরোধী বলে বাতিল করে দিতে পারে। অবশ্য এ ব্যাপারে মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের আরো ব্যাপক ক্ষমতা রয়েছে।

5) বিশেষ আদালতের অবস্থিতি- ভারতে বিভিন্ন ধরণের বিশেষ আদালত রয়েছে। যেমন, চাকুরি সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য রয়েছে প্রশাসনিক আদালত, ক্রেতার স্বার্থ সুরক্ষিত করার জন্য রয়েছে ক্রেতা সুরক্ষা আদালত, অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ মামলা নিষ্পত্তির জন্য রয়েছে লোক আদালত ইত্যাদি। এইসব আদালতে অল্প ব্যয়ে বা বিনা ব্যয়ে দ্রুত বিরোধের নিষ্পত্তি ঘটে। 

6) মৌলিক অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে ভূমিকা- ভারতীয় নাগরিকদের মৌলিক অধিকার রক্ষা করার ক্ষেত্রে সুপ্রিমকোর্ট ও হাইকোর্টগুলির বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। 32 নম্বর ধারা অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্ট এবং 226 (1) নম্বর ধারা অনুযায়ী হাইকোর্ট ভারতীয় সংবিধানে স্বীকৃত মৌলিক অধিকারগুলি সংরক্ষণ করার জন্য বন্দী প্রত্যক্ষীকরণ, পরমাদেশ, প্রতিষেধ প্রভৃতি নির্দেশ, আদেশ বা লেখ জারি করতে পারে।

7) সময়সাপেক্ষ- ভারতীয় বিচারব্যবস্থার অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হল দীর্ঘসূত্রিতা। বেশিরভাগ মামলার নিষ্পত্তি হতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়।

8) ব্যয়বহুল- ভারতের বিচারব্যবস্থা যথেষ্ট ব্যয়বহুল। উকিল এবং কোর্ট-ফি বাবদ যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয় তা সাধারণ দরিদ্র মানুষের পক্ষে বহন করা কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়।

9) শাসনবিভাগের নিয়ন্ত্রণ- ভারতের ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি প্রযুক্ত হয়নি। এইজন্য বিচারবিভাগের ওপর শাসনবিভাগের প্রত্যক্ষ প্রভাব বর্তমান। বিচারপতিদের নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি ইত্যাদি বিষয়গুলি শাসনবিভাগের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভরশীল।

10) সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতা- যেকোনো বিচারব্যবস্থার প্রাথমিক উদ্দেশ্যই হল 'আইনের দৃষ্টিতে সমতা' প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু ভারতে এই নীতির সার্বিক প্রয়োগ সম্ভব হয়নি। ভারতের সংবিধানে এমন কিছু নির্দেশ রয়েছে যার ফলে বিচারবিভাগের পক্ষে আইনের দৃষ্টিতে সমতা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, রাষ্ট্রপতি ও রাজ্যপালগণ পদাধিকারবলে ক্ষমতা প্রয়োগ ও কর্তব্য সম্পাদন করতে গিয়ে যেসব কার্য করেন সেজন্য তাদের কোন আদালতের কাছে কৈফত দিতে হয় না, যতদিন তারা স্বপদে বহাল থাকেন ততদিন পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি মামলা দায়ের করা যায় না, স্বপদে বহাল থাকাকালীন কোনো আদালত তাদের গ্রেফতারের নির্দেশ দিতে পারে না ইত্যাদি। 

11) জুরির ব্যবস্থা নেই- আধুনিককালে বেশ কিছু রাষ্ট্রে জুরির সাহায্যে বিচারকার্য পরিচালনা করা হয়। গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স প্রভৃতি রাষ্ট্রে জুরির সাহায্যে বিচারকার্য সম্পাদন করা হয়। কিন্তু ভারতে জুরির সাহায্যে বিচারের কোনো ব্যবস্থা নেই।

12) ভ্রাম্যমাণ আদালত নেই- ভ্রাম্যমাণ আদালত হল এমন এক ব্যবস্থা যেখানে আদালত বিচারপ্রার্থীর কাছে গিয়ে হাজির হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং গ্রেট ব্রিটেনে এরকম ব্যবস্থা রয়েছে। ভারতে ভ্রাম্যমাণ আদালত নেই।

13) বিচারবিভাগীয় সক্রিয়তা- ইদানিংকালে ভারতের বিচারবিভাগের সক্রিয়তা অনেকখানি বৃদ্ধি পেয়েছে। শাসনবিভাগের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বিচারবিভাগ বর্তমানে ভারতের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সবক্ষেত্রেই ব্যাপক হস্তক্ষেপ শুরু করেছে এবং এই কাজে জনগণের বিপুল সমর্থন লাভ করেছে। বিভিন্ন সময়ে সুপ্রিমকোর্ট এবং হাইকোর্টসমূহ প্রচলিত এক্তিয়ারের বাইরে গিয়ে জনস্বার্থ বিষয়ক বিভিন্ন ঐতিহাসিক রায় দান করে ভারতীয় বিচারব্যবস্থাকে গৌরবান্বিত করেছে।

পরিশেষে বলা যায়, ভারতের বিচারব্যবস্থা যথেষ্ট শক্তিশালী, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ। এর কিছু ত্রুটি, কিছু সীমাবদ্ধতা অবশ্যই আছে। কিন্তু সেসবের ঊর্ধ্বে উঠে ভারতের বিচারবিভাগ ভারতের জনগণের জন্য ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর। আবার, ক্ষমতা ও প্রভাবের দিক থেকে বলা যায়, ভারতের বিচারব্যবস্থা মার্কিন বিচারব্যবস্থার মতো শক্তিশালী নয়, আবার বিচারব্যবস্থার মত দুর্বলও নয়।