Header Ads Widget

header ads

Ticker

6/recent/ticker-posts

দ্বাদশ শ্রেণি- আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিকাশ

International Relation

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক


দ্বাদশ শ্রেণি (রাষ্ট্রবিজ্ঞান)
অধ্যায়- আন্তর্জাতিক সম্পর্ক


[West Bengal Council of Higher Secondary Examination (WBCHSE) Class 12 Political Science Questions and Answers in Bengali; Chapter- International Relation; Question- Evolution of International Relation.]


প্রশ্ন- আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সংজ্ঞা লেখো। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিকাশের ধারা সংক্ষেপে আলোচনা করো। [2+6]



উত্তর- সমাজবিজ্ঞানের একটি উল্লেখযোগ্য শাখা হল আন্তর্জাতিক সম্পর্ক (International Relation)। নাম দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে, এই শাস্ত্রটি বিভিন্ন রাষ্ট্রের আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক একটি স্বতন্ত্র শাস্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেও এর কোনো সুসংবদ্ধ সংজ্ঞা দেওয়া সম্ভব নয়। এর কারণ হল, বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সংজ্ঞা নির্ণয় করেছেন। যেমন-


অধ্যাপক পামার ও পারকিনসের মতে, বিশ্বের সব মানুষ ও গোষ্ঠীর যাবতীয় সম্পর্ক, মনুষ্যজীবন, তাদের কার্যকলাপ ও চিন্তার প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণকারী শক্তি, চাপ ও প্রক্রিয়া নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক আলোচনা করে। 


অধ্যাপক নিকোলাস স্পাইকম্যানের মতে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে বসবাসকারী ব্যক্তিবর্গের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করে। 


আবার, হার্টম্যানের মতে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক হল এমন একটি বিষয় যা বিভিন্ন রাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করে।


এইভাবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে বিভিন্ন পন্ডিত বিভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। এইসকল সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একটি যুক্তিপূর্ণ সংজ্ঞা দেওয়া যেতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক হল এমন একটি শাস্ত্র যা বিভিন্ন রাষ্ট্র, আন্তর্জাতিক সংগঠন, বহুজাতিক সংস্থা, স্বার্থগোষ্ঠী প্রভৃতির আন্তঃসম্পর্ক এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিভিন্ন দিক যথা, কূটনীতি, বিশ্বশান্তি, জনমত, রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রভৃতি নিয়ে আলোচনা করে।


আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিকাশের ধারা


বর্তমানে যেসব বিষয়গুলি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অন্তর্ভূক্ত সেগুলি নিয়ে বহু আগে থেকেই আলোচনা শুরু হয়েছিল। যেমন, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রেও এক রাজ্যের সঙ্গে অন্য রাজ্যের সম্পর্ক নিয়ে গভীর আলোচনা রয়েছে। কিন্তু সেসময় যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত ছিল না বলে সেই সকল নীতি আঞ্চলিক স্তরে প্রয়োগ করা হত। আধুনিককালে চর্চিত আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সূচনা কাল আনুমানিক বিগত শতকের কুড়ির দশকে। মোটামুটিভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই বিভিন্ন মহলে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনা শুরু হয়। সেই সময় থেকে এখনো পর্যন্ত একটি পাঠ্য বিষয় হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিকাশের ধারাটি এইরকম-


প্রথম পর্যায়: আদর্শবাদী ধারা


প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ ধ্বংসলীলা প্রত্যক্ষ করার পর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে ভাবনাচিন্তার সূত্রপাত হয়েছিল। এই পর্যায়ের চিন্তকগণ যুদ্ধ এবং নৈরাজ্যের অবসান ঘটিয়ে এমন এক বিশ্ব গঠনের পরিকল্পনা করেছিলেন যেখানে চিরশান্তি বিরাজ করবে এবং রাষ্ট্রগুলি যুদ্ধ থেকে বিরত থাকবে। এই পর্যায়ের একজন নেতৃস্থানীয় চিন্তাক হলেন প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক আলোচনার এই ধারাকে আদর্শবাদী ধারা বলা হয়।


দ্বিতীয় পর্যায়: বাস্তববাদী ধারা


আন্তর্জাতিক সম্পর্ক আলোচনা আদর্শবাদী ধারার বিরুদ্ধে বাস্তববাদী ধারার সূত্রপাত হয়েছিল। এই ধারার অন্যতম প্রবক্তা হলেন ই. এইচ. কার, হ্যান্স জে. মর্গেনথাউ, হার্বার্ট বাটারফিল্ড, জর্জ কেনান প্রমুখ। এদের মতে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ন্ত্রিত হয় ক্ষমতা অর্জন এবং সম্প্রসারণের মাধ্যমে; অর্থাৎ, ক্ষমতাই হল আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নিয়ন্তা।


তৃতীয় পর্যায়: বিজ্ঞানভিত্তিক ধারা


আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষণের বাস্তববাদী তাত্ত্বিকগণ ক্ষমতাকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কেন্দ্রে স্থাপন করেছিলেন এবং রাষ্ট্রীয়-আচরণ নিয়ন্ত্রণকারী অন্যান্য বিষয়গুলিকে উপেক্ষা করেছিলেন। মূলত এই তত্ত্বের বিরোধিতা করেই গত শতকের মাঝামাঝি সময়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক ধারার সূত্রপাত ঘটে। এই ধারার কয়েকজন প্রবক্তা হলেন স্ট্যানলি হফম্যান, কার্ল ডয়েশ্চ, রিচার্ড স্নাইডার প্রমুখ। বস্তুতপক্ষে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরিবর্তিত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় বাস্তববাদী তত্ত্ব মুখ থুবড়ে পড়েছিল। এই অবস্থায় রাষ্ট্রগুলির পারস্পরিক সম্পর্ক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োগ করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল।


চতুর্থ পর্যায়: মার্কসীয় ধারা


আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষণের উপরোক্ত তিনটি ধারার পাশাপাশি মার্কসীয় ধারাটিও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মার্কসবাদীরা অর্থনীতিকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নিয়ন্ত্রক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাদের মতে, অর্থনীতির আলোচনা ছাড়া আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনা ভিত্তিহীন। লেনিনের লেখা 'Imperialism: The Highest Stage of Capitalism' এবং নিকোলাই বুখারিনের লেখা 'Imperialism and World Economy' গ্রন্থদুটিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে মার্কসীয় ধারণার সন্ধান পাওয়া যায়।


আন্তর্জাতিক সম্পর্ক একটি ক্রমশ উন্নয়নশীল এবং জটিল একটি শাস্ত্র। যত দিন যাচ্ছে, এর পরিধি ততই বিস্তারিত হচ্ছে। একটি বা দুটি মতবাদ বা তত্ত্ব দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনা চলতে পারেনা। এইজন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মতবাদ জন্ম নিয়েছে এবং সেগুলি নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষণের চেষ্টা করে গেছে। যেমন, গত শতকের ষাটের দশকে 'পারস্পরিক নির্ভরশীলতা তত্ত্ব' এবং প্রায় সমকালে 'বিশ্বব্যবস্থা তত্ত্ব', আশির দশকে নয়া 'বাস্তবতাবাদ তত্ত্ব' বিকাশ লাভ করেছিল। 


পরিশেষে বলা যায়, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক একটি সদাগতিশীল বিষয় এবং যত দিন যাচ্ছে ততই এর পরিধি ক্রমশ সম্প্রসারিত হচ্ছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে অনেক নতুন তত্ত্বের উদ্ভব ঘটছে এবং ভবিষ্যতেও আরো নতুন নতুন তত্ত্বের উদ্ভব ঘটবে- একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।